মধ্য
ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় অংশ নেন বেশি।
স্বপ্ন থাকে খেলার দক্ষতা দিয়ে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করবেন। কিন্তু সবার
সেই স্বপ্ন পূরণ হয় না। আর্থিক অনিশ্চয়তাই খেলাধুলায় নারীদের কম আসার
প্রধান কারণ। একটি গবেষণা থেকে এই তথ্যই উঠে এসেছে।
গিনেস বুকে নাম তুলে জোবেরা রহমান লিনু তো ইতিহাসই তৈরি করেছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশকে ভালোভাবেই তুলে ধরছেন সালমা খাতুনেরা।
নারী ক্রীড়াবিদদের হাত ধরে বাংলাদেশ কম সাফল্য পায়নি। কিন্তু এখনো
খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম। কেন? সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এর কারণগুলো
বেরিয়ে এসেছে।
জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় অংশ নেওয়া নারীদের ৮৩ শতাংশই
আসেন মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। তাঁদের স্বপ্ন থাকে, খেলায় দক্ষতা
দিয়ে চাকরি পেয়ে পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। তবে তাঁদের মধ্যে মাত্র
৩৪ শতাংশ চাকরি পেয়েছেন। বাকিরা তেমন চাকরি বা আর্থিক কোনো নিশ্চয়তা
পাননি। আর্থিক এই অনিশ্চয়তাই খেলাধুলায় নারীদের কম আসার প্রধান কারণ।
‘যেসব
কারণে বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাধার সম্মুখীন: একটি
সামাজিক সমীক্ষা’ শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আশরাফ উদ্দিন আহমেদ তাঁর এমফিল
পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে গবেষণাটি করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, নারীরা খেলাধুলার
সঙ্গে জড়িত থাকলে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব। এর মাধ্যমে শিক্ষার হার,
নেতৃত্বগুণ বাড়ানো ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটানো যাবে। ফলে নারীর ক্ষমতায়ন
হতে পারে।
মেয়েরা আসছে। তবে গতিটা ধীর। এমনটাই মনে করেন সাবেক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। বললেন, ‘উচ্চশিক্ষা ও
ক্রীড়া—দুটো ক্ষেত্রই ব্যয়বহুল। আবার খেলাধুলায় আর্থিক নিশ্চয়তা থাকে না,
তাই হয়তো পরিবার নিরুৎসাহিত করে মেয়েটাকে। তাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে,
মেয়েদের পেছনে কোনো বিনিয়োগ করলে তার ফল ভালো হয়।’ এ ক্ষেত্রে স্থানীয়
সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি। তারা পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে।
‘আরেকটা
কথা অনেকে বলেন, মেয়েরা শারীরিকভাবে অত সক্ষম নয়। এটা অর্থহীন কথা।
মেয়েদের শরীর ও মনের জোর কতটা, তা একজন মেয়ে যখন মা হয়, তখনই বোঝা যায়।
ফলে পরিবারের কোনো মেয়ে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হলে তাকে উৎসাহিত করতে
হবে। ছোটবেলা থেকে সংস্কৃতিচর্চার মতো, খেলাধুলার চর্চা করা উচিত।’ বললেন
রাশেদা কে চৌধূরী।
বিভিন্ন ক্রীড়ায় জাতীয় পর্যায়ে খেলছেন এমন ১০০
নারীর মধ্যে জরিপ চালিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এঁদের অর্ধেক ফুটবল, ক্রিকেট,
ভলিবল, হ্যান্ডবল, কাবাডি ইত্যাদি এবং বাকি অর্ধেক দাবা, টেনিস,
ব্যাডমিন্টন, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার ইত্যাদি ক্রীড়ায় জড়িত।
জরিপে অংশ
নেওয়া খেলোয়াড়দের ২৫ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত
পড়েছেন ২৩ জন। ৬৩ জনের পরিবারের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকার কম। ২০ থেকে ২৫
হাজার টাকা মাসিক আয় ২০ জনের পরিবারের। এঁদের ৪৬ শতাংশই দিনে কমপক্ষে
দু-তিন ঘণ্টা অনুশীলন করেন। তবে তাঁদের জন্য সাধারণ পুষ্টিসম্পন্ন খাবার
কেনা কষ্টসাধ্য। অংশগ্রহণকারীদের ৬৩ শতাংশই প্রথমে খেলতে আসেন কোনো
প্রশিক্ষণ ছাড়া। এ জন্য তাঁরা প্রশিক্ষণের উপযুক্ত স্থানের সংকট, ঘরের কাজে
সময় দেওয়া ও নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করেন।
খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে নিয়ে
নারীদের এগিয়ে না আসার কয়েকটি কারণ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান কারণ
আর্থিক অনিশ্চয়তা। এর পাশাপাশি মৌলিক চাহিদার জন্য অন্যের ওপর
নির্ভরশীলতা, লিঙ্গবৈষম্য, পরিবারের বিরোধিতা, নারীদের বিশেষায়িত ক্লাব না
থাকা, নিয়মিত টুর্নামেন্ট না হওয়া এবং অনুশীলনের জায়গার অভাবকে চিহ্নিত
করেছেন ক্রীড়াবিদেরা। গবেষণায় বলা হয়েছে, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত
পরিবার থেকে আসা নারী খেলোয়াড়দের বেশির ভাগেরই লক্ষ্য থাকে, আনসার ভিডিপি,
পুলিশ, বিজেএমসি—এমন সার্ভিস টিমে খেলা, যাতে তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি
পেতে পারেন এবং ভালো প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেকে আরও দক্ষ করতে পারেন। কিন্তু
সারা দেশে জাতীয় পর্যায়ে হাজারেরও বেশি নারী খেলোয়াড়ের মাত্র ৩৪ শতাংশই
এমন চাকরি করছেন।
নারী ক্রীড়াবিদদের পাওয়া এই চাকরিতে মাসিক বেতন সাড়ে
ছয় থেকে নয় হাজার টাকা। কারও চাকরিই স্থায়ী নয়। জাতীয় পর্যায়ে ৫০টি
স্বর্ণপদক পাওয়া খেলোয়াড়ের চাকরিও স্থায়ী হয়নি। এমনকি ২৫ বছর চাকরি করার
পরও তা স্থায়ী না হননি এমন খেলোয়াড়ও আছেন। নারী খেলোয়াড়দের পরিবার মনে
করে, খেলাধুলায় জড়ানো মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হবে। তবে
তাঁরা চাকরি পেলে পরিবারের সমর্থন পান।
জরিপে অংশ নেওয়া নারী
খেলোয়াড়দের ৫৩ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা তাঁদের মেয়েকে খেলাধুলায় উৎসাহ দেবেন।
বাকি ৪৭ শতাংশ বলেছেন, আর্থিক অনিশ্চয়তা, কম আয় ও কম সম্মানের কারণে তাঁরা
নিজেদের মেয়েকে এই জগতে আনবেন না।
দেশের
দ্রুততম মানবী নাজমুন নাহার বিউটি বলেন, ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে সরকার যেমন
সুযোগ-সুবিধা করে দিচ্ছে, অ্যাথলেটিকসেও তেমনটা দরকার। অনেক মেয়েরই
খেলাধুলায় আগ্রহ আছে। সামাজিক সমস্যাগুলো এখন আগের তুলনায় কমেছে। তবে
আর্থিক সমস্যার কারণে মেয়েরা খেলাধুলার জগতে আসতে পারেন না।
১০০ ও ২০০
মিটার দৌড়ে ১১ বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন বিউটি বলেন, অ্যাথলেটিকসের মতো একক
খেলায় কষ্ট বেশি। এসব খেলায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই আসেন।
তাঁদের মধ্যে যাঁরা চাকরি নিয়ে ক্লাবগুলোতে খেলেন, তাঁদের বেতন খুব কম।
তাঁরা পড়াশোনাও করেন। এত কষ্টের তুলনায় তাঁরা কিছুই পান না।
গবেষণায়
বলা হয়েছে, ক্রীড়াক্ষেত্রে নারী খেলোয়াড়দের যে পরিমাণ ত্যাগ, তার বদলে
যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা তাঁরা পান না। তবে বৈষম্যের বেড়াজালেও তাঁরা
সাফল্য দেখাচ্ছেন। মেয়েদের জন্য তেমন টুর্নামেন্ট নেই, ক্লাবও নেই। প্রতিটি
থানা ও জেলা পর্যায়ে মেয়েদের টুর্নামেন্ট করা প্রয়োজন। যেসব মেয়ে
খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত, চাকরিক্ষেত্রে তাঁদের জন্য কোটার ব্যবস্থা রাখা
দরকার।
৪৪ শতাংশ নারী খেলোয়াড় মনে করেন, শুধু নারী হওয়ার কারণে তাঁদের
সামাজিকভাবে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাঁরা জানিয়েছেন, অনুশীলনে যাওয়ার
সময়ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সমালোচনা শুনতে হয়। বাকিরা বলেছেন, প্রথম
দিকে তাঁরাও এমন সমস্যায় পড়েছেন। ক্যাম্পে যোগ দিতে ঢাকায় এলে
প্রতিবেশীরাও অপবাদ দিতেন।
গবেষণায় বলা হয়, খেলাধুলায় সরকারি বরাদ্দ
নিয়ে ৬০ শতাংশ নারী খেলোয়াড়ই অসন্তুষ্ট। তবে এটি মানতে নারাজ সাবেক
ব্যাডমিন্টন তারকা, বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কামরুন
নাহার ডানা। তিনি বলেন, সরকারি যা বরাদ্দ, তা তো খরচই হয় না। স্কুল
পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু ঢাকা শহরে খেলাধুলার মাঠ নেই,
দখল হয়ে গেছে। গ্রাম পর্যায়ে খেলাধুলাই নেই। বাবা-মায়েরা অনাগ্রহী হয়ে
উঠছেন, বাচ্চারা ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। পড়াশোনা হয়ে গেছে
কোচিংনির্ভর। ফলে তারা খেলার সময় পায় না।
এত সমস্যার পরও খেলাধুলায়
মেয়েদের আগ্রহ রয়েছে। যেমন, ২০১২ সালের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব
গোল্ডকাপ ফুটবল। সরকারি উদ্যোগে এ টুর্নামেন্টে ৬০ হাজার ৮০১টি প্রাথমিক
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হয়ে ১০ লাখের বেশি মেয়ে শিক্ষার্থী অংশ নেয়। গবেষণার
সুপারিশে বলা হয়েছে, খেলাধুলায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ক্লাবগুলোর জন্য
নারী দল রাখাটা বাধ্যতামূলক করা যায়। নারী খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়াতে
বিদ্যালয়ের বড় ভূমিকা নিতে হবে। কারণ, বিদ্যালয়েই মেয়েদের সহজে খেলায়
সম্পৃক্ত করা যায়। মেয়েদের জন্য জেলায় আলাদা প্রতিষ্ঠানও খুব জরুরি।
এই
গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক
সমস্যাগুলোর সমাধানে সচেতনতামূলক কাজ করতে হবে। যেসব মেয়ে খেলাধুলায় ভালো
করছে, তাদের সামনে এনে রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। নারী
প্রশিক্ষক বাড়াতে হবে। মেয়েদের খেলাধুলায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় আনতে হবে। নিয়মিত
টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে। তবেই মেয়েরা খেলাধুলায় আরও আগ্রহী হবে।